দুর্গাসাগর এক কালে বরিশালের পরিচিত ছিল প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবে। শস্য ও সম্পদে ভরপুর ছিল বাংলার এই দক্ষিণাঞ্চল বরিশাল। আর এ কারণেই বর্মী ও পতুরগিজ জলদস্যুদের লুন্ঠনের শিকার হতো এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এবং এরকম পরিবেশে চন্দ্রদীপপ রাজার কীর্তিমান পুরুষ রাজা রামচন্দ্র শ্রীনগর মাধবপাশায় চন্দ্র দ্বীপের প্রাচীন বরিশাল রাজধানী স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। রামচন্দ্রের সেই রাজত্ব আর রাজবাড়ীর রাজত্ব এখন আর দেখা না গেলেও কালের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে কয়েকটি দিঘী। আর সেই দিঘীগুলোর মধ্য সবচেয়ে বড় দীঘিটি হলো দুর্গা সাগরদিঘী। এটি শুধু বরিশালই নয় গোটা দক্ষিণ অঞ্চলের দিঘীগুলোর মধ্য এটি অন্যতম।
রাজবংশের রাজা শিব নারায়ণ তার স্ত্রী রানী দুর্গাবতী নাম অনুসারে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে বিশাল এই দিঘী খনন করেছিলেন বলে জানা যায়। এখানে দিঘির বিশালতাকে বুঝানোর জন্যই সাগর শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। 1974 সালে তৎকালীন সরকারের উদ্যোগে পুনরায় সংস্করণ করা হয়। বর্তমানে দিঘির উন্নয়ন ও পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসনের অধীনে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রচলিত হচ্ছে।
দুর্গসাগর হল বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা বরিশালের অন্তর্গত বরিশাল জেলা শহর থেকে প্রায় 12 কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে স্বরূপকাঠি নেছারাবাদ গামী সড়কের পাশে মাদবপাশায় এর অবস্থান।
দুর্গা সাগর এর দিঘির জলভূমির আকার ২৭ একর এবং পার্শ্ববর্তী পার ও জমি সহ মোট আয়তন ৪৫.৪২ একর। দিঘির মাঝখানে ৬০ শতাংশ ভূমির একটি দ্বীপ রয়েছে। চারদিকে নিল জলরাশির মাঝে মনে হয় একটি দ্বীপ ভাসছে।
পর্যটক এবং প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে এটি একটি চমৎকার নান্দনিক স্থান। এখানে রয়েছে মেইনগেটের ঠিক সামনেই দিঘিতে নামার জন্য বেশ বড় আকারের সিমেন্টের তৈরি সিঁড়ি। সিড়ির ধাপ গুলো একদম পানির নিস পর্যন্ত বিস্তৃত। যার মাধ্যমে খুব সহজেই দিঘির জলে নামা যায়। ঘাটলাটি দেখতে খুবই চমৎকার।এই ঘাটলার সিঁড়ির ধাপগুলো বেশ চওড়া এবং মার্বেল টাইস বসানো। ঘাটলার দুই পাশে রয়েছে বসার জায়গা। পর্যটকরা বসার জায়গায় কেউ বিশ্রাম করেন, কেউ আবার দিঘির জলে নামে, কেউ আবার ক্যামেরার মাধ্যমে এখানকার সৌন্দর্য ও নিজেকে ছবির ফ্রেমে বন্দী করে রাখে। ঘাটলার পাশে রয়েছে রঙিন মাছ এর একুরিয়াম। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার রঙিন মাছ, যা দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। মেইন গেটের ঠিক সামনে ঘাটলায় নামার আগে রয়েছে পুরনো দিনের একটি বটগাছ। যার ডালপালা বিস্তৃত হয়ে ছাতার আকার ধারণ করেছে। যার ছায়া তলে বসার মজাটাই অন্যরকম।
দিঘির পাড়ে রয়েছে সরু পায়ে হাটা পাকা রাস্তা। মাঝে মাঝেই রয়েছে বসার বেঞ্চ, মাঝে মাঝে রয়েছে সিমেন্টের তৈরি বসার ছাউনি। চারপাশে রয়েছে বিভিন্ন রকমের গাছগাছালি। মেইন গেট থেকে শুরু রাস্তা ধরে সামনে এগুলি রয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা। এই মিনি চিড়িয়াখানায় রয়েছে, হরিন, বানর, ময়ূর পাখি, ইত্যাদি পশুপাখি। একটু সামনে দেখা মিলবে কয়েকটি ফাস্টফুড এর দোকান। এই দোকান গুলোতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাবার। ইচ্ছে করলে এই ফাস্টফুট গুলোতে কয়েকজন বন্ধুরা মিলে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যায়।
সৌখিন ব্যক্তিদের মধ্য যারা বরশি দিয়ে মাছ ধরা পছন্দ করেন। তাদের জন্য রয়েছে দিঘির চারপাশে মাছ ধরার চৌকি বসানো। এসব চৌকিতে বসে টিকিটের মাধ্যমে বরশি দিয়ে মাছ ধরতে পারেন। বিভিন্ন লোকের ভিড় দেখা যায় মাছ ধরার জন্য। এদের মধ্য রয়েছে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা। কে কত বড় এবং কত বেশি মাছ ধরতে পারে।
দুর্গসাগরের চারোপাশ উচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। যার জন্য এখানে রয়েছে নিরাপত্তার সুব্যবস্থা। দীঘির জলে ভেসে বেড়ানোর জন্য রয়েছে স্পিডবোটের মত নৌকার ব্যবস্থা। যেগুলোতে ভেসে বেড়ানোর জন্য টিকিটের প্রয়োজন হয়। টিকিট কেটে মনের আনন্দে দিঘির জলে ভেসে বেড়ানো যায়।
সর্বোপরি বলা যায় মনোরম পরিবেশ দক্ষিণ অঞ্চলের পর্যটন কেন্দ্র। এখানে ভ্রমণের জন্য আসলে আপনাদের যেমন মনের খোরাক পরিপূর্ণ হবে। আবার তেমনি ইতিহাস সম্পর্কে জানা হবে।
দুর্গা সাগরে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার পাখির সমরহ। যারা সবসময় এই দীঘির পরিবেশকে মুখরিত করে রাখে। এই দিঘীটিতে শীতের মৌসুমে লক্ষ্য করা যায় প্রচুর অতিথি পাখি। এদের মধ্যে রয়েছে, সরাইল, বালিহাঁস ইত্যাদি অনেক পাখি। যারা দীঘির পানিতে ভেসে বেড়ায় সাঁতার কাটে কখনো কখনো এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে উড়ে যায় যা দেখতে খুবই চমৎকার লাগে।
ঢাকা থেকে সড়ক অথবা নদী এবং আকাশ উভয় পথেই বরিশাল যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে ভোর .৬ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে অনেক বাস বরিশালের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ঢাকা থেকে আগত বাসগুলো বরিশালের নতুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ডে থেমে থাকে। এসি এবং নন এসি বাস রয়েছে। এসি বাসের ভাড়া .৭০০ টাকা এবং নন এসি বাসের ভাড়া ৫০০ টাকা। সড়ক পথে ঢাকা থেকে বরিশাল আপনি তিন ঘন্টায় পৌঁছাতে পারবেন। ঢাকা থেকে বরিশালে চলাকালীন কিছু বাস গাড়ির নাম দেওয়া হলঃ
ঢাকা থেকে লঞ্চে করে বরিশাল যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে বরিশালের লঞ্চগুলো রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। এর মধ্যে সুন্দরবন ৭-৮, সুরভি পারাবাত ১১, কীর্তনখোলা ১-২ লাঞ্চগুলো ভালো। লঞ্চগুলো বরিশাল পৌঁছায় ভোর পাঁচটার দিকে। লঞ্চের কেবিন ভাড়া হবে ১৬০০ এবং ভি-আইপি ৪৫০০ টাকা। এই লঞ্চের ডেক ভাড়া হবে ১৫০ টাকা।
ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার জন্য কয়েকটি এয়ারলাইন্স রয়েছে। যাদের আলাদা আলাদা সময় ফ্লাইট বরিশাল বিমানবন্দরে ফ্ল্যাট সংখ্যা খুবই কম। মাত্র তিনটি এয়ারলাইন্স যারা ঢাকা টু বরিশাল যাত্রী সেবা চালু রয়েছে। বিমানের ভাড়া নির্মাণ করে আপনি কোন ধরনের এয়ারলাইন্স এ যাতায়াত করবেন তার উপর। কারণ একেক এয়ারলাইন্স এর বিমান ভাড়া এক এক রকম। নিচে তিনটি এয়ারলাইন্সের টিকিটের দাম আলোচনা করা হয়েছে। ইউএস-বাংলা, এয়ারলাইন ও বিমান বাংলাদেশ এই তিনটির মাধ্যমে ঢাকা থেকে বরিশাল ভ্রমণ করতে হবে। বিমান বাংলাদেশ এর প্রায় ১০ হাজার টাকার মতন এবং সর্বনিম্ন তিন হাজার টাকা। ইউএস-বাংলা বিমান ভাড়া 4 থেকে 9000 টাকা। নভোএয়ার বিমান ভাড়া ১০০০০ টাকা। ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স প্রতিদিন দুইটি ফ্লাইট চলাচল করে। একটি প্রতিদিন সকাল .৮টা ও বিকেল .৪ঃ৩০মিনিটে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বরিশাল থেকে ঢাকা সকাল ৯ঃ১০ মিনিট ও বিকেল ৫ঃ৪০ মিনিটে ফিরে আসে। নভোএয়ার এয়ারলাইন্স প্রতিদিন একটি ফ্লাইট রয়েছে ঢাকা টু বরিশালের উদ্দেশ্যে বিকেল .৪টায় বিমান ছেড়ে দেয়। আবার বরিশাল টু ঢাকা বিকেল .৫ঃ১০মিনিটে যাত্রা শুরু করে। বিমানবাংলাদেশ লোকেশনে একটি ফ্লাইট পরিচালনা করে ঢাকা থেকে বরিশাল সকাল ১১ টায় যাত্রা শুরু হয়। বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে বিমানে দুপুর ১২ঃ১৫ মিনিটে ঢাকায় ফিরে আসে। আপনারা সঠিক সময়ের পূর্বেই এয়ারলাইন্স এসে অপেক্ষা করবেন। ভুলবশত একটি ফ্লাইট মিস হয়ে গেলে সেই দিন আর বিমানে করে ফিরতে পারবেন না।
বরিশাল নতুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে বরিশাল বানরী পাড়া বাসে দুর্গাসাগর নামতে হবে। এছাড়াও প্রাইভেটকার, স্কুটার, মাইক্রোবাস, সিএনজি ইত্যাদি যোগে আসা যায়। বরিশাল থেকে মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের পথ।
ঘাট সংলগ্ন স্থানে রয়েছে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো চাঁদনী রাতে দিঘির পাড়ে রাত কাটাতে ইচ্ছে করলে ভ্রমণকারীরা এখানে রাত কাটাতে পারেন। এছাড়া আপনি বরিশাল ফিরে আসতে পারেন। বরিশালে থাকার জন্য বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে। কিছু হোটেলর নাম দেওয়া হলোঃ
আরো পড়ুনঃভিন্ন জগত পার্ক
বোটানিক্যাল গার্ডেন সবুজের আচ্ছাদন আর নির্মল বাতাসের শান্ত নিরিবিলি স্থান হিসেবে পরিচিত । ময়মনসিংহ জেলার…
মালনি ছড়া চা বাগান হল বাংলাদেশের সিলেট জেলায় অবস্থিত। যা উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম চা বাগান।…
সাগর কন্যা দ্বীপ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপ। বরিশাল বিভাগের অন্তর্গত এই জেলা নাম ছিল দক্ষিণ…
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর একটি প্রত্নতবরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর রাজশাহী শহরে অবস্থিত। যেটি বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর। ত্ত্ব সংগ্রহে…
প্রয়াস সেনা বিনোদন পার্ক সবাই একটু কম বেশি চিত্তবিনোদনের জন্য বিভিন্ন বিনোদনের পাট এর খোঁজ…
বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত। চিড়িয়াখানাটি বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে…